দাঁত শক্ত, নাকি রুটি?

প্রোডাক্টের কোয়ালিটি ও প্রতিষ্ঠানের আভিজাত্য উভয়ের কল্যাণে ফুরফুরে আত্মবিশ্বাসে ফাইজারে কাজ করেছি। চাকরী পরিবর্তনের সময় আসলে একটা দেশীয় মধ্যম শ্রেণীর ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে যোগ দিলাম রিজিওনাল ম্যানেজের হিসেবে ।

প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির সেলস মার্কেটিঙে কাজ করলে বুঝতে কষ্ট হয় মানুষটা প্রোডাক্ট বিক্রি করে না প্রোডাক্ট মানুষটাকে বিক্রি করে?প্রতিষ্ঠিত প্রোডাক্টের কল্যাণে অখ্যাত মানুষটা মার্কেটে যেয়েই বিখ্যাত হয়ে যায়। তাই কে কাকে বিক্রি করে যাচাই করতে হলে নিম্ন সারির একটা কোম্পানিতে কাজ করা ভালো। তাহলে বোঝা যায় মানুষটার দক্ষতা।

ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির একটা নতুন প্রোডাক্ট বাজারে এনে শেল্ভিং করে বসে থাকলে চলে না। ডিসপেন্সিং মনিটর করতে হয় নিবিড়ভাবে। ভালভাবে শেল্ভিং করে দ্রুত সময়ে ঐ প্রোডাক্টের প্রেস্ক্রিপশান জেনারেট করতে হয়। যত দ্রুত ফার্মেসীর মালিক ঐ প্রোডাক্ট বিক্রি করতে পারবে তত দ্রুত তার মূলধন ও মুনাফা ঘরে আসবে।  তার আস্থা তৈরি হবে। এ ক্ষেত্রে দেরি হলে কাস্টমারের আস্থা অর্জন করা সম্ভব হয় না। রিপিট অর্ডার হয় না। প্রেস্ক্রিপশান কিছু হলেও তা এক দুষ্টচক্রে পড়ে কোম্পানির ইমেজটাই নষ্ট করে।

সময় মতো প্রেস্ক্রিপশান করাতে না পারলে ঐ প্রেস্ক্রিপশান ফার্মেসীতে গেলে তা পরিবর্তন করে অন্য কোম্পানির একটা ব্র্যান্ড সার্ভ করে এবং ডাক্তার জেনে যায় যে ঐ প্রোডাক্ট বাজারে পাওয়া যায় না। এই অজুহাতে ডাক্তার আর ঐ প্রোডাক্ট প্রেস্ক্রাইব করেন না। মার্কেটিয়ার পড়েন এক জটিল চক্রের মধ্যে।

আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে পণ প্রথা শুরু হয়ে গেছে। “কেহই করে লেনা দেনা কেহই কান্দে রাস্তায় পড়ে…”  আব্দুল আলিমের মরমী গানের শাব্দিক অর্থের মতো যে বা যারা যৌতুকের মতো ডাক্তারকে দিতে পারে তারাই প্রেস্ক্রিপশানের সিংহভাগ কব্জা করে নেন।

ফাইজারের মতো প্রথম সারির ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে কাজ করে ডাক্তারদের কাছ থেকে গগনচুম্বী সমাদর পেয়েছি। ট্যুরে যেয়ে যে ডাক বাংলোয় উঠেছি অনেক ডাক্তার সেখানেই দেখা করতে আসতেন। অনেক হাসপাতালের কোয়াটারে থাকতে হয়েছে। হোটেলে উঠলে সমপরিমাণ টাকা আদায় করতো ডাক্তার বন্ধুরা। উল্ল্যেখ্য, প্রফেশনাল জ্ঞানের বাইরে আমার বেশ কিছু এক্সট্রা কারিকুলার কোয়ালিটি, যেমন সাহিত্য, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, সঙ্গীত, অর্থনীতি, ইতিহাস, তুমুল আড্ডা জমানো ইত্যাদির জন্য সারা জীবন আমি কর্মক্ষেত্রে একটু বিশেষ কদর পেয়ে এসেছি। একমাত্র আমি বি এম এ’র পারিবারিক অনুষ্ঠানেও আমন্ত্রিত অতিথি হয়েছি।

ফাইজারে একজন ওষুধের দোকানদার কিছু ব্রান্ডের ওষুধ একটু বেশী পাওয়ার জন্য অনুনয় করতো। সেই আমার জীবনে শুরু হল এক চরম পরীক্ষা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমার বগুড়ার জীবনের যুদ্ধ জয় আমাকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল যে পরবর্তীতে অন্য কম্পানি থেকে অনেক সুযোগ সুবিধা সহ জাতীয় পর্যায়ের দায়িত্ব নেওয়ার ডাক পাই।

নতুন সহকর্মী সহ বগুড়ার সাতমাথায় এক ফার্মেসীতে গেলে আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন,”আপনারা কতদিন থাকবেন? আমাদের ডেট এক্সপায়ার্ড ওষুধ গুলো নিয়ে যান। তাড়াতাড়ি পালটায়ে দিয়েন।“ ম্যাসেজ পেয়ে গেলাম। নার্ভ শক্ত করলাম।

জানতে পারলাম  “হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন-শক-হূন–দল  পাঠান-মোগল এক দেহে হল লীন।“ ‘র মতো অনেকে চাকরী নিয়ে এসেছিল কিন্তু  পায়ের নীচে মাটি শক্ত করতে না পেরে প্রস্থান করেছে। বেতন নিয়ে গেছে, রেখে গেছে শুধু আমাদের জন্য ডেট এক্সপায়ার্ড ওষুধ আর কাস্টমারের অনাস্থা।

বাস্তবতা হাড়ে হাড়ে বুঝে গেলাম। আমি তখন ভিস্মের শর-শয্যার মতো অবস্থায়। গগন থেকে ভুতলে পতিত আমার কপাল নতুন করে গড়তে হবে। আনকোরা কলিগকে হালকা করতে হবে নইলে চাকরী ছেড়ে পালাবে। ফার্মেসীকে সার্ভিস দিতে হবে। বিগত দিনের  ডেট এক্সপায়ার্ড ওষুধ গিলতে হবে। নতুন করে প্রোডাক্ট শেল্ভিং ও প্রেসক্রিপশান করাতে হবে।

পরদিন কাজ বন্ধ করে সবাইকে নিয়ে অফিসে বসলাম। বুঝে গেছিলাম যে তথাকথিত  অ্যাকশান প্ল্যানে কোন কাজ হবে না। আমাকেই তৈরি করতে হবে এই পরিস্থিতি উত্তরণের পরিকল্পনা।

চা নাস্তায় রিলাক্সাড হয়ে কথা শুরু করলাম। “আমরা বিরল ভাগ্যবান। এমন বিরূপ পরিস্থিতি জয় করতে পারলে আমাদের ভবিষ্যতের  পেশাজীবনের, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সমস্ত রকমের সঙ্কট সামাল দিতে একটুও বেগ পেতে হবে না। তাদেরকে শোনালাম দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে জার্মান বাহিনী রাশিয়া আক্রমন করলে পৃথিবীর ইতিহাসের সেই বিখ্যাত স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধের কথা যেখানে মেয়েরাও রান্না ঘর থেকে ছুরি, বটি নিয়ে যুদ্ধ করে জিতেছিল। খন্দকের যুদ্ধে হযরত সালমান ফার্সি প্রস্তাবিত সেই অভূতপূর্ব যুদ্ধ কৌশলের কথা। মহাভারত বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বিজয়ী অর্জুনের বীরত্ব যিনি যুদ্ধের দশম দিনে ভীষ্মকে পরাজিত করেছিলেন। নিজ পুত্র অভিমুন্যকে হারায়েও বীর অর্জুন পাণ্ডবদের বিজয় নিশ্চিত করেন।“

সবাই আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বুর। বললাম, আমারা কাস্টমাইজ প্ল্যান করে কাজ করবো। আসলে নেতা যদি দলের সাথে কাঁধ মিলায়ে কাজ করে সেখানে সাফল্য আসা সময়ের ব্যাপার।

পরদিন সেই ফার্মেসীতে যেয়ে আমরা বললাম, আপনি ওষুধ বিক্রি করলে আমরা এই প্রতিষ্ঠানের হয়েই আসব। মুদিখানা করলে চাল, ডাল কিনতে আসব, দর্জিগিরি করলে টুপি বানাতে আসব।তবে আসব। আমরা যাবার জন্য আসিনি। থাকতে এসেছি।“

পরিকল্পনা করলামঃ সময়, শক্তি, প্রোমো-টুলস কোন কিছুই আমরা অপচয় করবো না। বেশী গুরুত্ব দিয়েছিলাম প্রতিটা সহকর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তুখোড় সেলসম্যান হিসেবে তৈরি করতে। নিজেকে বস মনে না করে আমি তাদেরই একজন হয়ে সকাল সন্ধ্যা তাদের সাথে কাজ করেছি, কাজ শিখায়েছি। আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছি।

ডাক্তারদের প্রোফাইল সংগ্রহ করে কাস্টমার রিলেশানশিপ মার্কেটিঙের উপর নজর দিয়েছি। সামান্য প্রোমো-টুলস দিয়ে অসামান্য রেজাল্ট আনতে শিখায়েছি। ‘আনউজুয়াল টাইমের’ সদ্ব্যবহার করেছি। যেমন, সকালে অনেক ডাক্তার নিজ বাসায় কিছু রুগী দেখে তার পর হাসপাতালে যান। ঐ সময় কল করার ব্যবস্থা  করেছি। রাত দশটার পর ইমারজেন্সিতে কোন কোম্পানি থাকতো না, আমি  সার্ভিস দেওয়ার রীতি চালু করেছিলাম।রাতে ইনডোর’এ কোন কোম্পানি থাকতো না, আমি সেই সুযোগটা নিয়েছি। ব্যক্তির কোয়ালিটি ও প্রোডাক্টের কোয়ালিটির সমন্বয়ে অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসে মার্কেটে।

শীর্ষস্থানের  ডাক্তারদের সাথে এমন সম্পর্ক তৈরি করেছিলাম যে তাদের কারো কারো প্রেস্ক্রিপশানে কোন প্রোডাক্টের সারা নর্থবেঙ্গলের টার্গেট হয়ে যেতো।

৬ মাসে মধ্যে নতুন প্রোডাক্ট শেল্ভিং করতে গেলে সেই ওষুধের দোকানদার বলল যে আপনাদের প্রোডাক্ট না রাখলে তো চলবে না। অমুক অমুক ডাক্তার তো ঠাণ্ডা লাগলেও এইটা লিখবে আবার কলেরা হলেও এইটা লিখবে। অর্থাৎ লিখবেই।

আত্মবিশ্বাস, কাস্টমাইজড প্লানিং, রিসোর্সের উত্তম ব্যাবহার, রিলেশানশিপ মার্কেটিং এবং সর্বোপরি “দাঁত শক্ত, না রুটি শক্ত” এই নাছোড়বান্দা মানসিকতাই আমাদেরকে বিজয়ী করে।

 

This article was also published on the 4th Marketing Day (2021) Publication.

Share this article
Shareable URL
Prev Post

Leadership Strategies and Tools to Open the Future of Innovation and Growth

Next Post

বিকল্প ধারার বিজ্ঞাপন প্লাটফর্মঃ টেলিভিশন চ্যানেল বনাম সামাজিক মাধ্যম

Read next

নতুন বাস্তবতায় মার্কেটিং

গণমাধ্যম, ইন্টারনেট ও বহিরাঙ্গণ ডিসপ্লে দ্বারা সৃষ্ট বাস্তবতা দেখে এমন ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে, সারাক্ষণ সবাই…

বিকল্প ধারার বিজ্ঞাপন প্লাটফর্মঃ টেলিভিশন চ্যানেল বনাম সামাজিক মাধ্যম

একটা সময় ছিলো লাখ লাখ টাকা খরচ করে মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে বিজ্ঞাপন দেয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিলো না। টিভি চ্যানেলগুলোতে…

‘তোমার ভাঁজ খোলো, আনন্দ দেখাও’ বনাম ওয়ানপ্লাসের সাফল্যের তর্জমা

সম্প্রতি অনলাইনে আত্নপ্রকাশ করা মোটোরোলার পুরনো ফ্ল্যাগশিপ মডেল ’রেজর’এর নতুন সংস্করণটা দেখলাম, এটি ২০২০ সালের…
0
Share