কাস্টমার কিংবা গ্রাহক মার্কেটিং-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের মতো এত বিশাল জনসংখ্যার দেশে গ্রাহকের সংখ্যা অনেক, সবাইকে গ্রাহক হিসেবে চিন্তা করা যতটা সহজ বাস্তবে রূপ দেয়া ততটাই কঠিন। ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে দেশের সংখ্যার রূপ অনেকটা পিরামিড আকৃতির; এর উপরে রয়েছে উচ্চবিত্ত শ্রেণী, মাঝে মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং শেষে নিম্মবিত্ত শ্রেণী।
উচ্চবিত্ত শ্রেণীর ক্রয় ক্ষমতা অনেক, কিন্তু সংখ্যায় অনেক কম। এই শ্রেণির গ্রাহকদের দেশি ব্র্যান্ডের তুলনায় বিদেশি বা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোকে অধিক পছন্দ (Preferer) করে। পিরামিডের মাঝে থাকা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংখ্যা অনেক বেশি কিন্তু তাদের ক্রয়ের ক্ষেত্রে অনেক চিন্তা-ভাবনা করতে হয়। একবারে নিচে থাকা নিম্মবিত্ত শ্রেণী, যাদের সংখ্যা উচ্চবিত্তের তুলনায় বেশি কিন্তু মধ্যবিত্তের তুলনায় কম। সব শ্রেণীর মানুষের কাছে মার্কেটের পণ্য কিংবা সেবাগুলোর আকর্ষণ কিন্ত এক নয়। যেমন, একজন উচ্চবিত্ত শ্রেণীর কাছে ব্র্যান্ড যতটা গুরুত্ব বহন করে একজন মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্মবিত্তের কাছে ততটা করে না। তাই মার্কেটিং-এ আসলে ব্র্যান্ডিং বিষয়টি একটু আংশিকভাবে রয়েছে। ক্রেতা কিংবা গ্রাহকের অবস্থা বিবেচনায় তার পছন্দের জিনিস তার কাছে পৌঁছানোই হচ্ছে ব্র্যান্ডিং।
Branding is all about reaching the appropriate customer with appropriate offer. Different solutions for different categories of customers – this might the smallest summation of branding activities। Branding has different meaning for different class of customers. A brand might be very attractive to high-class customers but it might have less or even zero attraction to middle or lower class customers.
– Nur Al Ahad (2019)
কাস্টমার কিংবা গ্রাহকদের বিবেচনা করে অনেক রকম ব্র্যান্ডিং আমাদের করতে হবে, এ জন্য আসলে দরকার কাস্টমার প্রোফাইলিং, যা আমাদের দেশে তেমন করে করা হয় না। আমাদের দেশে যদিও কাস্টমার সার্ভে চালু আছে কিন্তু প্রোফাইলিং ব্যাপারটা আসলে তেমন করে নেই। কাস্টমার প্রোফাইলিং হচ্ছে কাস্টমারদের ইন্ডিভিজুয়াল ফাইলিং যাতে তাদের সম্পর্কে অনেক রকম তথ্য থাকে। এই রকম প্রোফাইল কিছু স্পেসিফিক এরিয়া কিংবা স্পেসিফিক গ্রুপ অফ কাস্টমার এর জন্য হতে পারে। আবার জাতীয়ভাবে একটি ডাটাবেস তৈরী করেও এই রকম কাস্টমার প্রোফাইল তৈরী করা যেতে পারে। এই প্রোফাইল থেকে কাস্টমার সম্পর্কে তথ্য নিয়ে সেই অনুযায়ী ব্র্যান্ডিং কিংবা প্রমোশনাল একটিভিটিসগুলো করা যেতে পারে। সব কাস্টমার এক নন, সবাই ভিন্ন। তাই আমাদের কাস্টমারদের শ্রেণী কিংবা ক্যাটাগরি সম্পর্কে জানা দরকার। আমাদের দেশের কাস্টমারদের এই রকমভাবে শ্রেণী বিভক্ত করা যেতে পারেঃ
1. Brand Conscious Customer
এই শ্রেণীর কাস্টমার সাধারণত উচ্চবিত্ত হয়ে থাকে এবং ব্র্যান্ড নিয়ে অনেক চিন্তা থাকে এদের।কাস্টমারদের জন্য দরকার স্ট্রং ব্র্যান্ডিং স্ট্রাটেজি। যেমন বেশ কিছুদিন আগেই আড়ং নিয়ে অনেক রকম কথাবার্তা হলো। যদিও এতে আড়ং এর মার্কেট ডিমান্ড কিছুটা কমে যাবার কথা। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে আড়ং এর brand conscious customer base অনেক বেশি। আর এই ধরণের brand conscious লোকজন অনেক হার্ড কোর হয়ে থাকেন। যত কিছুই হোক না কেন এদের ব্র্যান্ড থেকে দূরে সরানো কষ্টকর। অ্যাপেল প্রোডাক্টের ক্ষেত্রেও একই জিনিস প্ৰযোজ্য।
2. Price Conscious Customer
এই শ্রেণীর কাস্টমাররা প্রাইস নিয়ে অনেক চিন্তায় থাকেন। আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত এবং নিম্মবিত্ত শ্রেণীর অনেকেই এই শ্রেণীর কাস্টমার। ডিসকাউন্ট এবং অন্য প্রমোশনাল একটিভিটিসগুলো দরকার বেশি এই ধরণের কাস্টমারদের জন্য। আমাদের দেশে পাঠাও কিংবা অনেক রকম সার্ভিস আজকাল চালু রয়েছে। Price conscious কাস্টমারদের নিজেদের রেগুলার কাস্টমার বানাতে তারাও অনেক উদ্যোগ নিতে পারেন। যেমন পাঠাও ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিশেষ রাইড সার্ভিস চালু করতে পারেন যাতে স্টুডেন্ট কার্ড দেখতে পারলেই বিশেষ ডিসকাউন্ট দেয়া হবে। এতে করে দেশের বড় শহরগুলোতে বিশেষ করে ঢাকার ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে পাঠাও এর ডিমান্ড বাড়বে। আবার আমাদের দেশে FMCG কোম্পানিগুলোর বেশ কয়েক রকম ফুড প্রোডাক্ট রয়েছে যেগুলোতে এই রকম ডিসকাউন্ট ব্যবহার করে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ভালো কিছু করা যেতে পারে। আমাদের মতো দেশে কিন্তু অনেক ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে যেটা একটি বিরাট সম্ভবনাময় মার্কেট।
3. Price and Brand Conscious Customer
এই ধরনের কাস্টমাররা দুইটাই চান – ব্র্যান্ড এবং প্রাইস। এই ধরণের কাস্টমার দের সন্তুষ্ট করা একটু বেশি কষ্টকর অন্যদের মতো। এই ধরণের কাস্টমার দের ব্র্যান্ডিং এবং প্রোডাক্ট অনেক রকমভাবে মিক্স করে বের করতে হয়। যেমন, Samsung এর ফ্ল্যাগশিপ স্মার্টফোন হচ্ছে গ্যালাক্সি S সিরিয়াস, কিন্তু ঐগুলোর দাম বেশি থাকায় অনেক কাস্টমার ফোনগুলো কিনতে পারে নি। Samsung কতৃপক্ষ বিষয়টি বুঝতে পেরে J সিরিজ, A সিরিজ ইত্যাদি একটু কম দামের সেট বাজারে নেমে। বাস্তবিক পক্ষে সমাজে এই ধরণের কাস্টমারদের সংখ্যা অনেক এবং এদের রয়েল কাস্টমার বানাতে পারলেই ব্যবসায়ের সফলতা অনেকখানি নিশ্চিত হবে। আমাদের দেশে সিম্ফনি একটি ভালো মোবাইল ব্র্যান্ড। সিম্ফনি চাইলে আরো বেশ কিছু মিড্ রেঞ্জ দামের মধ্যে ভালো ফোন বের করতে পারে যেগুলো এই শ্রেণীর কাস্টমারদের কাছে আকর্ষণীয় হবে।
4. Niche Customer
এ শ্রেণীর কাস্টমাররা সমাজের নিম্মবিত্ত শ্রেণীর হয়ে থাকেন। মার্কেটিং এর অনেক পণ্য এবং সেবাই এদের কাছে ঠিকমত পৌঁছে না। তবে এই শ্রেণীর জন্য কিছু করতে পারলো মার্কেটে অনেক ভালো কিছু করা যাবে। আমাদের দেশে গ্রামে কিংবা একদম প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে ছোট সাবান, ছোট প্যাকেটের শ্যাম্পো ইত্যাদি চালু রয়েছে। আমাদের মতো দেশগুলোতে স্মার্টফোন কিন্তু সবার হাতে নেই। আবার ফীচার ফোন গুলোও মার্কেটে তেমন করে এতটা পাওয়া যায় না। এই ক্ষেত্রে ওয়াল্টন এগিয়ে আসতে পারে পল্লী ফোন নামে একটি স্মার্টফোন বের করার মাধমে। বহু বছর আগে ভারতের গ্রামগুলোতে গরমের দিনে ঠান্ডা পানি পাওয়া কষ্টকর ছিল কারণ গ্রামে বিদ্যুৎ ঠিক করে থাকতো না আবার ফ্রিজ কেনার মতো আর্থিক সামর্থ গ্রামের মানুষগুলোর ঠিক করে নেই। এই ক্ষেত্রে গোদরেজ এগিয়ে আসে এই নিচ মার্কেটে। Chotukool নামে গ্রামের মানুষদের জন্য বিশেষ একটি ফ্রিজ তৈরী করে বাজারে আনে তারা। আমাদের দেশের এমন জায়গায় রয়েছে যেসব জায়গায় গ্যাস সরবরাহ হয় না। সেই ক্ষেত্রে সিলিন্ডার কিংবা মাটির চুলার উপর নির্ভর করে থাকতে হয়। এই ক্ষেত্রে এই মার্কেটটি অনেক দিন থেকেই ব্লু ওশান। এই মার্কেটে একটু চিন্তা করলে ইনোভেটিভ কোনো প্রোডাক্ট introduce করা যেতে পারে, যেন রান্না হয় নিরাপদ ও সাশ্রয়ী।
5. Sudden Customer
মার্কেটিং জগতে Sudden কিংবা হটাৎ কাস্টমারও রয়েছে, এ ধরণের কাস্টমাররা সাধারণত নিত্য নতুন জিনিস কিংবা পণ্যটি করতে পছন্দ করেন। তবে লয়্যাল কাস্টমার হিসেবে এদেরকে বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই। সাডেন কাস্টমারদের আকর্ষণ করার জন্য জাপানের সুপার স্টোরগুলোতে মিনি ভিডিও ডিসপ্লে একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি। এই পদ্ধতি প্রায় প্রত্যেক পণ্যের ক্যাটেগরির সামনে একটি মিনি ভিডিও ডিসপ্লে থাকে যাতে পণ্য সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য দেয়া হয় ১-২ মিনিটের মধ্যে। এতে কাস্টমার আগ্রহী হয়ে পণ্যটি কিনে নিতে পারেন। আমাদের দেশে এই রকম কিছু করা যেতে পারে আবার ভিন্নধর্মী কিছুও করা যেতে পারে।
6. New Customer
নিউ কিংবা নতুন কাস্টমার হচ্ছেন তারা যারা প্রথম বারের মতো আপনার পণ্য কিংবা সেবা ব্যবহার করবেন। নিউ কাস্টমারদের লয়্যাল কাস্টমার এ পরিণত করা একটি কষ্টকর এবং সময় সাপেক্ষ কিন্তু ওয়ার্ড অফ মাউথ এর মাধ্যমে অনেক নতুন কাস্টমার পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। যেমন এই রকম একটি জিনিস হতে পারে সাডেন ডিসকাউন্ট। কোনো কাস্টমার যদি প্রথম বারের মতো আপনার কোনো প্রোডাক্ট কিংবা সার্ভিস কিনে তাহলে তাকে সাডেন ডিসকাউন্ট দেয়া যেতে পারে। তবে এই রকম পদ্ধতি প্রয়োগ করতে প্রথমে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে।
আজকাল মার্কেটিং জগতে disruptive innovation এর বিকল্প নেই। ভিন্নধর্মী কিছু করতে পারলেই প্রবল প্রতিযোগিতার মাঝে টিকে থাকা সম্ভব। আর সব থেকে বড় হলো কাস্টমারের সাথে সম্পর্ক রাখতে হবে সব সময়। দিন শেষে ব্র্যান্ডিং, সেলিং, প্রমোশন আমরা যাই বলি না কেন সবই এক দিকে আমাদের নিয়ে যায় – হিউমান টু হিউমান রিলেশনশিপ।
Marketing is human to human relationship for mutual benefit। Happy customers give birth to happy businesses। And to make customer happy and the relationship better we need to understand the categories of customers।
– Nur Al Ahad (2019)
আরও পড়ুনঃ
মার্কেটিং নামা ১
মার্কেটিং নামা ০২ – কোয়ান্টিটেটিভ মার্কেটিং Quantitative Marketing
মার্কেটিং নামা ০৩ : ওয়ার্ড অফ মাউথ (Word of Mouth- WOM)
মার্কেটিং নামা ০৪ : গেরিলা মার্কেটিং Guerrilla Marketing
Nur-Al-Ahad
BBA (University of Dhaka, Bangladesh) 14th Batch
MBA (University Putra Malaysia, Malaysia)
Master of Engineering (Toyohashi Tech, Japan)
Email: nur.al.ahad.mkt@gmail.com